আসসালামু আলাইকুম, কেমন আছেন টেকটিউনস কমিউনিটি? আশা করছি সবাই ভাল আছেন। আজকে আপনাদের দারুণ একটি তথ্য দেব! সাথে থাকবে বিশ্লেষণ। তো চলুন শুরু করা যাক
আমি মনে করতে পারছি না শেষ কবে এমন কোন ফোন বা অন্য ডিভাইস লাঞ্চিং ইভেন্ট দেখেছিলাম যার রিলিজ হবার দুই সপ্তাহ বা ১ মাস আগে তথ্য লিক বা ফাঁস হয় নি। বছরের পর বছর এই ফোন লিক বা তথ্য ফাঁস বেড়েই চলেছে যার মাধ্যমে একটি ফোন ঘোষণা এর আগে এর সকল তথ্য জেনে যাচ্ছি। একটা মজার বিষয় হচ্ছে, কোম্পানিগুলো এই অবৈধ তথ্য ফাঁসকে অনেকটা মেনে নিয়েই তথ্য ফাঁসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছে এবং নিজেরাই তথ্য ফাঁস বা পণ্যের টিজার বের করছে। এর মানে এখন তাদের এটা মেনে নিতে হচ্ছে কারণ লিক এড়ানো এখন প্রায় অসম্ভব।
কিভাবে ইনফরমেশন লিক বা তথ্য ফাঁস হয়?
ইন্ডাস্ট্রি গুলোতে বিভিন্ন ভাবে তথ্য ফাঁস বা লিক হতে পারে। কখনো কখনো কোম্পানির সাপ্লাই চেনের ভেতরের কেউ ফোনের ছবি ফাঁস করে দিতে পারে অথবা বাইরের লোকেরাও বিভিন্ন অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে অথবা অন্য কোন পেজে তথ্য ফাঁস করে দিতে পারে। যেমনটা হয়েছিল Google Pixel 3 এর সাথে, ফোন বের হবার আগেই রিভিউ ভিডিও সবার কাছে চলে আসে।
বর্তমানে এটা বলা কষ্টকর যে কোনটা বেআইনি ভাবে ফাঁস হচ্ছে বা কোনটা পরিকল্পিতভাবে ম্যানেজমেন্ট দ্বারা হচ্ছে। আমি মনে করি এটা বের করা সহজ যে কোম্পানি গুলো আসলে এই তথ্য ফাঁসের বিপরীতে কি পদক্ষেপ নিচ্ছে। অ্যাপলের তথ্য ফাঁস করার জন্য তাদের কর্মীদের চাকরীচ্যুত এমনকি জেলে যেতে ও হয়েছিল এর কারণ আমরা হয়তো জানি।
কোম্পানি কি চায় তথ্য ফাঁস হোক?
সাধারনভাবে কোন কোম্পানি এটা চায় না। কোম্পানি গুলা সচারাচর তাদের প্রোডাক্ট এর তথ্য কখন কোথায় প্রকাশ করবে সেটা নিয়ন্ত্রণ করে কারণ তারা চায় তাদের পণ্য সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য গোপন থাকুক যাতে করে ক্রেতারা পণ্য সম্পর্কে আগ্রহী হতে পারে। কোম্পানি গুলো চায় একটি নির্দিষ্ট টাইমে বড় করে আনুষ্ঠানিব ভাবে তাদের ডিভাইস গুলোর তথ্য প্রকাশ করতে যাতে করে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীরা তাদের ফিচার নকল করতে না পারে। কিন্তু দিনের পর দিন এই লিকের পরিমাণ বেড়েই চলেছে এবং বিভিন্ন উৎস থেকে ছবি লিক হচ্ছে। কোম্পানির সাপ্লাই চেইন দিনের পর দিন বিশ্বব্যাপী আরও লম্বা এবং বেশি প্রক্রিয়াধীন হয়ে যাওয়াতে এই লিক নিয়ন্ত্রণ করা আরও কঠিন হয়ে পরছে।
তাদের কি করা উচিৎ?
ফোন গুলো বিশ্বব্যাপী বিক্রি হয়, তার মানে তাদের অনেক বেশি অথোরিটি থেকে সার্টিফাইড হতে হয়। অন্যদিকে রিটেইলারা ফোন লঞ্চ করলে ক্রেতারা পণ্যের কেস সহ বিভিন্ন এক্সারসোরিস কিনতে চায়। এজন্য তারা আগে থেকে এগুলা বানাতে শুরু করে যার মাধ্যমে বর্তমানে এই লিক ব্যবসায় অন্যতম লাভবান ব্যবসায় রুপান্তরিত হয়েছে। এই লিক বন্ধ করা ও চোখে চোখে রাখা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তাই স্বাভাবিক ভাবে কিছু কোম্পানি এর সাথে লড়াই করা বাদ দিয়ে এটা মেনে নিয়েছে।
এটা নিয়ে মুটামুটি একটা গবেষণা করে আমি তিনটি স্ট্রেটেজি পেয়েছি যা বর্তমানে কোম্পানি গুলো গ্রহণ করছে, চলুন দেখে নেয়া যাক।
স্ট্রেটেজি ১
Google Pixel এর ঘটনাটি এর সঠিক উদাহরণ হতে পারে। ফোনটির তথ্য এমন ভাবে আগেই ফাঁস হয়ে গিয়েছিল যে লাঞ্চিং ইভেন্টে নতুন করে বলার মত কিছুই ছিল না। এমনকি কোম্পানিটি তাদের লাঞ্চিং ইভেন্ট শুরু করেছিল Google Pixel 3 এর সম্পর্কে বলা বিভিন্ন ইউটিউবদের ভিডিও দিয়ে। এর মাধ্যমে এটা স্পষ্টত যে তারা Pixel 4 ফাঁস থেকেও আটকাতে পারবে না। তাই তারা নিজেরাই আগে থেকে Spatial Tracking এর সাথে তাদের নতুন ক্যামেরা প্রযুক্তি সম্পর্কে জানিয়ে দেয়। তারা এটি করেছিল আগে থেকে নেতিবাচক সমালোচনা থেকে বাঁচতে। মানুষ অভিযোগ করেছিল ফোনটির সামনের বেজেল এবং ক্যামেরার বাষ্পটি একটু বেশি বড়। এতে করে তারা পরবর্তীতে ফোনের ফিচারে চেঞ্জ আনতে পেরেছিল। আমি মনে করি অন্যরা তথ্য লিক করে দেয়ার থেকে নিজেরা আগে ফিচার বলে দেওয়া ভালো।
স্ট্রেটেজি ২
২য় কৌশলটি জানতে হলে আমাদের OnePlus এর দিকে তাকাতে হবে। তারা যেটি করেছিল সেটি হচ্ছে তারা লিকের আশার বসে না থেকে নিজেরাই ফোন রিলিজের ১ মাস আগে টিজার দিয়ে দেয়। OnePlus তাদের প্রথম ফোন থেকেই, ফোনের আন-বক্সিং ভিডিও, বিভিন্ন ফিচারের ভিডিও এবং রোম এর ভিডিও দিয়ে দিতো এবং ফোনের ছবি রিলিজ করতো। তারা তাদের টিভির ক্ষেত্রেও একই স্ট্রেটেজি গ্রহণ করে।
তারা তাদের পণ্যের ক্ষেত্রে দারুণ কিছু পদ্ধতি অবলম্বন করে। প্রথমে ফোনের দাম ৫০০ ডলারের কম ঘোষণা করে পরে ৪০০ ডলার, ৩৫০ ইউরো এবং ফাইনালি ফোনের দাম ধরা হয় ২৯৯ ডলার যার মাধ্যমে ক্রেতারা ফোনের প্রতি আকৃষ্ট হয়। তাদের আরেকটি দুর্দান্ত ট্রিক ছিল তারা তাদের ফোনে কিছু অবাঞ্ছনীয় ফিচার ফোন রিলিজ দেয়ার আগেই লিক করে দিয়েছিল। এতে আমার ও অনেকের মনে হয়েছিল এই ফোনটি আই-ফোন Knockoff এর মত হবে এবং এতে কিছুটা নেতিবাচক খবর ছড়িয়ে পরলেও তা বেশি দিন স্থায়ী হয় নি। কিন্তু মানুষ এতে ফোনের প্রতি আরো বেশি আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি যদিও টিভির ক্ষেত্রে টিজার কিছুটা বোরিং তবুও তাদের পদক্ষেপ টি খারাপ না।
স্ট্রেটেজি ৩
৩ নাম্বার স্ট্রেটেজি হচ্ছে কোম্পানি গুলো তাদের আগামী যুগান্তকারী প্রযুক্তির তথ্য হয় আগে থেকে লিক করে দেবে অথবা টিজার বানাবে যা এখনো তৈরি হয় নি। এর মানে হচ্ছে তারা সামনে যে প্রযুক্তি নিয়ে আসবে তা সেটি তৈরির আগেই সবাইকে জানিয়ে দেবে। এর উদাহরণ হিসাবে Oppo কে দেখানো যেতে পারে। Oppo তাদের 5x অপটিকাল জুম প্রযুক্তির ভিডিও, এই প্রযুক্তি ফোনে আসার ২ বছর আগেই তারা এর ভিডিও রিলিজ করে দিয়েছিল।
একই কাজ তারা আবার করেছিল, তারা এক বছর আগেই Super Vooc নামের দ্রুত চার্জিং প্রযুক্তির ভিডিও প্রকাশ করেছিল।
এভাবে প্রযুক্তি আগেই উন্মুচিত করা কোম্পানিদের জন্য কিছু ঝুঁকিরও, কারণ এতে করে প্রতিদ্বন্দ্বীরা আগে থেকেই ধারনা পেয়ে যায়। কিন্তু এর কিছু পজিটিভ দিকও আছে। যেমন এর মাধ্যমে তারা তাদের প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্ব বিশ্ববাসীকে দেখাতে পারে। টেক কোম্পানিদের আসলে এ ধরনের শো অফ করা উচিৎ কারণ এতে করে কোম্পানির প্রতি নতুন নতুন প্রতিভাবান কর্মীরা আগ্রহী হবে, বিনিয়োগকারীরা আকৃষ্ট হবে এবং প্রতিদ্বন্দ্বীরা কোম্পানির প্রতি ভয়ে থাকবে।
উদাহরণ হিসাবে Oppo এর এক কর্মীর বক্তব্য দেখা যাক, “ আমি যখন Oppo তে কাজ করতাম এবং যখন সুপার চার্জিং এর ডেমো দেখাচ্ছিলাম তখন সেখানে কয়েকশত Samsung, Huawei, LG সহ অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বীরা এটি দেখতে এসেছিল। আমার মতে Oppo যেভাবে প্রতিদ্বন্দ্বীদের দেখাচ্ছে যে তারা কতটা অগ্রগামী এতে করে তার কমপিটিটররা এই টেক ফিল্ডে বিনিয়োগ করবে না কারণ তারা কখনোই কম সময়ে Oppo কে ধরতে পারবে না। সুতরাং এভাবে আগে থেকেই নতুন প্রযুক্তির ঘোষণা দিয়ে Oppo একটি কম্পিটিশন ল্যান্ডস্কেপ তৈরি করতে চাচ্ছে। “
শেষ কথা
আমি এভাবে ইনফরমেশন লিক বা তথ্য ফাঁস কে খারাপ কিছু বলব না। কারণ এটা যেহেতু নিজেরা করছে সুতরাং বুঝেই করছে। এমন নিজেস্ব লিক বা তথ্য ফাঁসের পেছনে আরও অনেক কারণ থাকতে পারে, যেমন অনেকে প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিভ্রান্ত করতে অথবা লিকের পেছনের জড়িত কর্মচারীদের ধরতে Fake Leak (ভুয়া তথ্য ফাঁস) করে থাকে।
আমার এই বিশ্লেষণ মূলক টিউনটি কেমন লাগল তা অবশ্যই জানাবেন এবং এমন আরো টিউন নিয়মিতই আসবে তাই সাথেই থাকুন। আর সবসময়ের মত বলব ভাল থাকুন এবং করোনা থেকে সাবধানে থাকুন।